-ইকবাল আহমেদ লিটন
বিপ্লবের তত্ত্ব, রাজনীতি এবং প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে নেতা, কর্মী ও জনসাধারণকে একই লাইনে শিক্ষিত করে তোলার অপরিহার্য শর্ত হলো সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনাধীন নেতারা তা বুঝতে চান না, তারা সমালোচনা করা মানেই তাদের বিরোধিতা করা বলে মনে করে থাকেন। এই মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায় না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন – আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি চাই।তিনি বলেছিলেন, কিছু কিছু লোক যখন মধু-মক্ষিকার গন্ধ পায় তখন তারা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমায়। আওয়ামী লীগের নামে লুটতরাজ করে। পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা, আওয়ামী লীগ থেকে তাদের উৎখাত করে দিতে হবে- আওয়ামী লীগে থাকার তাদের অধিকার নাই। তাই বলছি, আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে, আজ আত্মসংযমের প্রয়োজন আছে, আজ আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে। তোমরা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা আজ যারা এখানে বসেছ তারা মনে মনে চিন্তা কর। বুকে হাত দিয়ে খোদার উপর নির্ভর কইরা বলো যে, আমরা মানুষকে ভালোবাসি। আমরা বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আমরা ২৫ বছর সংগ্রাম করেছি। আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। আমরা ইতিহাস রাখবো। তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো। তা না হলে আমার বড় দুঃখ, কষ্ট। সহকর্মী ভাই ও বোনেরা- নীতি ছাড়া, আদর্শ ছাড়া এবং যে কথা আমি বলেছিলাম আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি ছাড়া তা হয়না। ন্যায় নীতি ও আদর্শ সামনে রাখতে হবে। সে আদর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে।” (১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারী আওয়ামী লীগের দ্বি বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা অনুযায়ী আলোকপাত করলে বা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য রাজনীতি বিষয়ে তাত্ত্বিক ধারণা লাভের পাশাপাশি প্রয়োজন গণমানুষের মধ্যে কাজ করার প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা। জনগণের সেবক হয়ে ওঠাই একজন রাজনীতিবিদের দায়িত্ব এবং এই সত্য কেবল মুখের কথা হিসেবে প্রচার করলে চলবে না। জার্মান রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়োহানেস আলথুসিয়াস যেমন বলেছিলেন, রাজনীতি হলো মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার শিল্প। আলথুসিয়াস মনে করতেন, ক্ষমতা শাসকের নয়, বরং তা সাধারণ মানুষের। রাজনীতিতে যারা অংশগ্রহণ করতে চান, তাদের আসল উদ্দেশ্য যদি হয় দেশের এবং দশের কল্যাণ সাধনের পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতাশালী করা, তাহলে রাজনীতির পরিবর্তে সৃষ্টি হবে শঠতা। রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশের মাধ্যমে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও নিজেদের জনগণের সেবক হিসেবে চিন্তা করার মানসিকতা তখনই টিকে থাকবে, যখন রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী হবেন। এই প্রজ্ঞা কি যে কেউ অর্জন করতে পারেন? উত্তর হচ্ছে, না। কারণ ক্ষমতাশালী হওয়ার পর ক্ষমতার অপব্যবহার করার দৃষ্টান্তও আমাদের চোখে পড়ে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করতে হয় প্লেটো বর্ণিত ‘সুন্দর জীবন’-এর কথা। আর্থিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক সম্মানপ্রাপ্তি নয় বরং প্রজ্ঞা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব যারা অনুধাবন করতে পারেন, তারাই বোঝেন প্রকৃত অর্থে সুন্দর জীবন কী। সুন্দর জীবনের অর্থ যারা বুঝতে পেরেছেন তারাই নৈতিক আচরণ আর পুণ্যকে অর্থ এবং খ্যাতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি তাদের কোনো মোহ থাকে না।
আধুনিক সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দল উভয় প্রতিষ্ঠানেরই দায়িত্ব যথাযথ রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এই রাজনৈতিক শিক্ষার অংশ হিসেবেই দীর্ঘদিন সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করতে হবে। প্রবীণ, নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে এসে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে মূল্যবান রাজনৈতিক ধারণা অর্জন করতে হবে। প্রকৃত রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার প্রতাপ উপভোগ করা নয়, বরং জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করার মধ্যেই খুঁজে পান গভীর আনন্দ। রাজনীতিবিদদের তোষামোদ করা এটা সুবিধাবাদী প্রবণতা? প্রকৃত রাজনীতিতে প্রাধান্য পায় যৌক্তিক বিতর্ক আর আলোচনা। আত্মপ্রশংসা নয়, বরং আত্মসমালোচনা এবং আত্মবিশ্নেষণের গুরুত্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত বেশি। এখানেই পলিটিক্স আর প্রোপাগান্ডার পার্থক্য। যৌক্তিক সমালোচনা গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক আচরণ আরও পরিশুদ্ধ, পরহিতকর করার আগ্রহ এবং চর্চা কি আমরা বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি?
যাইহোক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ চোরাচালানি সহ সকল ধরনের জাতীয় শত্রুদেরকে আহবান করেছিলেন, তোমরা আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেদেরকে খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রমাণ কর। তা না হলে, আমি ৭কোটি বাঙালিকে রক্ষা করার জন্য কঠোর হতে বাধ্য হবো। বঙ্গবন্ধু যখন নিজের দলের ৪৩ জন সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭জন ছাত্র হত্যার জন্য নিজের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেফতার করে ঘরে বাহিরে জাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহন করেন। তখনি সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, স্বাধীনতা বিরোধী সহ জাতীয় শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে ও শিশু রাসেল সহ স্ব-পরিবারে হত্যা করে। ঠিক আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু কন্যা কঠোর অবস্থান নেওয়ার কারনে, জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া সৃষ্টি হলেও শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে বলে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, নেত্রীকে দমানোর জন্য। কিন্তু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর রক্তের সন্তান। তিনি বাবার মতো জীবন দিয়ে হলেও বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াই, চালিয়ে যাচ্ছেন, চালিয়ে যাবেন। আল্লাহ্ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হেফাজত করুন। শুদ্ধি অভিযান চলছে, চলবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন -ঘুষ, দুর্নীতির প্রশ্নে, কে কোন দল আমি চিনি না, আমি জানি না। আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নাই, আমি আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে ভয় করি না। সুতরাং সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা করা প্রতিটা নেতাকর্মীদের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। শোষিতের বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।
-লেখকঃ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, সদস্য সচিব আয়ারল্যান্ড আওয়ামী লীগ -ইকবাল আহমেদ লিটন