মো. নজরুল ইসলামঃ মানিকগন্জ
“চলচ্চিত্রের শিল্পরথে মানবতার গান করি,বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক সমাজ গড়ি” এই স্লোগান কে সামনে রেখে উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেন এর জন্মভিটা মানিকগঞ্জের বকজুরীতে তাঁর ১৫৮ তম জন্মজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে হীরালাল সেন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংঘ এবং বেসরকারি সংগঠন বারসিক এর যৌথ আয়োজনে আজ সকালে বকজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে মহান এই কৃর্তিমানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী ও নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
নাগরিক সংলাপে হীরালাল সেন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংঘের সভাপতি অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন এর সভাপতিত্বে ও বারসিক প্রকল্প সহায়ক ঋতু রবি দাস এর সঞ্চালনায় সংলাপে অংশগ্রহন করেন এ্যাডভোকেট মো: আব্দুর রাজ্জাক, প্রগতি লেখক সংঘের কোষাধাক্ষ অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র চক্রবর্তী, এ্যাডভোকেট মনিরা আফরোজ,বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক ডাঃ ভজন কৃষ্ণ বনিক, উন্নয়নকমী নীলিমা রানী দাস প্রমুখ।
বক্তারা বলেন আমাদের এই অঞ্চলে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেন, আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন, ড. অমর্ত্য সেনসহ অসংখ্য গুণীজনের জন্মগ্রহণ করায় আমরা খুবই গর্বিত অংশীদার। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় যে আমাদের মনন ও মগজে প্রগতিশীল হতে পারিনি বরং বিপরীত চর্চাই বেশি হচ্ছে। তারপরও আলোক শিখা হাতে নিয়ে কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক শোষণ মুক্ত সাংস্কৃতিক চেতনা বাস্তবায়নের কাজকে এগিয়ে নিতে নিরলসভাবে কাজ করছে। আজকের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী সকলেই তারই উত্তরসূরী। বক্তারা আরও বলেন তাদের স্মৃতি সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাভুক্তসহ সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ চাই।
উল্লেখ্য যে – হীরালাল সেন ভারতবর্ষের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অন্যতম একজন। তাঁর জন্ম ১৮৬৬ সালে, মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে। সে হিসাবে তাঁকে প্রথম বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা বললেও ভুল হবে না। আবার তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যেও প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা। কিন্তু এই গুণী মানুষটি সেভাবে আলোচনায় নেই। তিনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎ থেকে বিস্মৃত একটি নাম।
হীরালাল শুধু প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, একই সঙ্গে প্রথম চলচ্চিত্রশিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক, উদ্ভাবক, প্রযোজক, প্রদর্শক ও আমদানিকারক। নির্মাণ করেছেন বিজ্ঞাপন, প্রামাণ্যচিত্র ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন ও আধুনিকমনস্ক করে তোলার উদ্যোগ নেন। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষের শহর ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অভিজাত, মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনসাধারণের মধ্যে চলচ্চিত্র দেখিয়ে আধুনিকতা, দেশাত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করেন।
নিজ গ্রামের স্কুল থেকে তিনি নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। পরে কলকাতায় গিয়ে কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়াকালে ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হলে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় সমাপ্তি টানেন। এরপর ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফার হিসেবে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। হঠাৎ একদিন বিদেশিদের প্রদর্শিত চলচ্চিত্র দেখে তাঁর আগ্রহ জন্মে এর নির্মাণ ও প্রদর্শনের প্রতি। বিলেত থেকে ক্যামেরা আর প্রজেক্টর আনিয়ে শুরু করে দেন নানা দৃশ্য ধারণ ও প্রদর্শন। এরপর মঞ্চনাটকের দৃশ্য ধারণ করে প্রদর্শন শুরু করেন। থিয়েটারে অভিনীত ‘আলীবাবা ও চল্লিশ চোর’ পুরোটা ধারণ করে নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
হীরালাল সেনই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম চলচ্চিত্রকার, যিনি সিনেমাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কথা ভেবেছিলেন। তাঁর নির্মিত তথ্যচিত্র ‘অ্যান্টি-পার্টিশন ডেমনস্ট্রেশন অ্যান্ড স্বদেশি মুভমেন্ট অ্যাট দ্য টাউন হল, ক্যালকাটা অন ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৫’কে প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক অগ্নিদুর্ঘটনায় তাঁর সব নির্মাণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারপরও একই পথে নতুন করে দিশা খুজেন।
ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।