বিশেষ প্রতিনিধি:
দীর্ঘ কয়েক বছর থেকে সিলেট সীমান্ত দিয়ে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে দেশের প্রবেশ করছে ভারতীয় হরেক রকম পন্য। বিগত সরকারের শেষ সময়ে এসে বিষয়টি নজরে আসে প্রশাসনের। কিন্তু এরপর থেকে চোরাচালান বাণিজ্য আর কোনে ভাবেই বন্ধ করতে পারেনি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। এক সময় সীমান্তবর্তী থানাগুলোতে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জড়িয়ে পড়েন এই চোরাই ব্যবসার সাথে। পুলিশ ও সীমান্তের বিজিবি দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিয়োগ দেন তাদের নিজস্ব লাইনম্যান। অভিযোগ রয়েছে, সীমান্তবর্তী থানার ওসিদের ম্যানেজ করেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-পাতি সকলেই জড়িয়ে পড়েন চোরাচালান বাণিজ্যের সাথে। শেখ হাসিনার সরকার আর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বদলী হওয়ার সাথে-সাথে বদল হয়েছে চোরাচালানের লাইনম্যানের নাম ও পরিচয়। পুরাতন নিয়মে নতুন মোড়কে এবার বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে গুটিকয়েকজন লোক এবার নেমেছেন চোরাচালান বাণিজ্যে। পাশাপাশি চোরাকারবারিরাও প্রতিদিন নিত্য-নতুন কৌশল পাল্টে সড়ক ও নৌ-পথে তাদের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত ভাবে। যদিও ইদানিং বিভিন্ন থানা পুলিশ চোরোচালানের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করেছেন নতুন করে। কারণ সরকার বদলের সাথে সাথে বিভিন্ন থানার ওসিরা বদল হওয়ায় কিছুটা বেকায়দায় পড়েছেন চোরাকারবারিরা। তারপরেও চোরাচালানের চিনিসহ পন্য আটকের খবর পাওয়া যাচ্ছেনা তেমন একটা। বিগত সরকারের আমলে চোরাচালানের সাথে জড়িত সকল রাগব বোয়াল ছিলো আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায়, যার ফলে তাদেরকে কখনো কোন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করতে পারেনি। বিনিময়ে প্রতিদিন বড় অংকের টাকা সরবরাহ করতো পুলিশ বিজিবির লাইনম্যানদের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ সরকারের পট পরিবর্তন হলেও এসব চোরাকারবারীদের গ্রেফতার করতে পারছেনা আইনশৃংখলা বাহিনী। ইতিমধ্যে নতুন নিয়োগকৃত পুলিশ অফিসারসহ লাইনম্যানদের ম্যানেজ করে নিয়েছেন চোরাকারবারিরা। যদিও এর আগে লোক দেখানো দু-একটি অভিযানে মাঝে মধ্যে চোনাপুটি গ্রেফতার হতো। কিন্তু আসল চোরাকারবারিরা রয়ে যেতো ধরাছোঁয়ার বাহিরে।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকার বদলের সাথে-সাথে সীমোন্তের চোরাচালানের লাইনও বদল হয়েছে। আগে ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতৃত্বে ছিলো চোরাচালানের লাইনটি। বর্তমান সময়ে চোরাচালানের লাইনটি চলে গেছে কতিপয় বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রনে। পুরানো লাইনম্যানরাই চোরাকাবারীদের সাথে নতুন লাইনম্যানদের লিয়াঁজো করে ভাগের টাকা বুঝে নিচ্ছেন।
অনেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সাবেক ছাত্রলীগ-যুবলীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে নতুন রুপে একই পথে হাটছেন বিএনপির কিছু নামধারী নেতাকর্মীরা। তারা সুযোগ বুঝে জড়িয়ে পড়ছেন নানা রকম অপরাধের সাথে। যদিও বিএনপি কেন্দ্র থেকে বার-বার নির্দেশনা আসছে কোন দলীয় নেতাকর্মী কোন অপরাধের সাথে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে নেওয়া হবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা। কিন্তু কেন্দ্রের নির্দেশ কোন আমলে নিচ্ছেনা সিলেট জেলা ও মহানগরের বিএনপির নামধারী এই সব নেতাকর্মী। ত্যাগীরা কেন্দ্রের নির্দেশনা মানলেও যারা দীর্ঘদিন ১৫ বছর বিগত সরকারের নেতাকর্মীর সাথে আতাঁত করে ঘাপটি মেরে বসেছিলো। তারা এখন খোলস পাল্টে নতুন রুপে মাঠে নেমেছে। জড়িয়ে পড়ছে এসব বিতর্কিত কর্মকান্ডে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত দুটি সিফটে ভাগ করে সীমান্ত এলাকা থেকে তামাবিল মহাসড়ক দিয়ে সিলেটসহ সারাদেশে যাচ্ছে শত-শত ভারতীয় চিনি ভর্তি কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক, পিকাপ। চোরাকারবারিরা আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিতে এসব ট্রাক, কাভার্টভ্যানের প্রথমে চিনি বা চোরাইপথে নিয়ে আসা ভারতীয় পন্য বুঝাই করে উপরে বালু কিংবা পাথর বুঝাই করে অনাসেই চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সম্প্রতি, এসএমপি শাহপরাণ থানাধিন সুরমা গেইট পুলিশ ফাঁড়ির আইসি আজিজ এর নেতৃত্বে একটি অভিযানে এ রকম দুটি গাড়ি আটক করা হয়। আটককৃত গাড়ির চালকদের স্বীকারোক্তিতে গাড়িতে তল্লাসী চালিয়ে দেখা যায়, উপরে বালু এবং পাথর দিয়ে, নিচে শত-শত বস্তা চিনি নিয়ে যাচ্ছিলো ট্রাকগুলো। পরে চালকসহ ট্রাকগুলো আটক করে পুলিশ। এ সংক্রান্ত একটি মামলা রুজু করা হয় এসএমপির শাহপরাণ থানায়। এর আগে সিলেট পিরেরবাজার এলাকায় মেট্টোপলিটন ইউনিভার্সিটির সম্মুখের রাস্তায় ছাত্র-জনতা একটি ট্রাক আটক করে। তল্লাসী চালিয়ে দেখায় যায় প্রায় কোটি টাকার ভারতীয় কসমেটিক্স ভর্তি ট্রাকটি সিলেট শহরের দিকে আসছিলো। পরে ছাত্র-জনতা ট্রাকটি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চোরাচালানের নতুন লাইনম্যান হিসাবে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন শহরতলীর দাসপাড়া বালুটিকর গ্রামের মইন উদ্দিনের ছেলে জসিম উদ্দিন। তিনি নিজেকে বিএনপির নেতা হিসাবে পরিচয় দিলে প্রকৃত পক্ষে তিনি বিএনপির কোন পদধারী নেতা নন, তিনি ছাত্রলীগের হয়ে কাজ করছেন। স্থানীয়দের মতে রাত গভির হলে ভিড় জমে পিরেরবাজার থেকে বাইপাস পর্যন্ত। বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে জসিমের নেতৃত্বে একাধিক টিম রাস্তায় অবস্থান নিয়ে ট্রাক প্রতি ২০ হাজার টাকা করে লাইনের টাকা তুলেন। বিএনপি দলীয় চাঁদা না পুলিশের লাইনে টাকা তুলেন জসিম এমন প্রশ্ন এখন স্থানীয়দের মনে। জসিমের সাথে রয়েছেন একই এলাকার জনৈক আরেক ছাত্রদলের পদবীধারী নেতা, তিনি ও জসিমের হয়ে লাইনের টাকা উত্তোলন করেন। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক চোরাকাবারিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে সরাসরি ছাত্রলীগের দুটি গ্রæপের নেতারা দলীয় লাইনের টাকা নিতেন। পুলিশের লাইনের টাকা তোলার জন্য ছিলো আলাদা লাইনম্যান। সরকার বদলের সাথে-সাথে সেই টাকা নিচ্ছেন এখন বিএনপিসহ ছাত্রদলের কিছু নেতারা। সরকার বদলের সাথে সাথে চোরাকারবারিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নতুন রুপে জড়িয়েছেন চোরাচালানের সাথে। প্রতিরাতে লাইনম্যান জসিম জৈন্তাপুর থেকে ছেড়ে আসার ভারতীয় পন্যবাহী গাড়ির সামনে থাকেন একটি কার নিয়ে। তিনি চোরাইপন্যবাহী গাড়িগুলো বাইপাস হয়ে মুরাদপুর পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছেদেন। এভাবে প্রতিদিন ভারতীয় শতশত পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান।
তিনি প্রতিটি গাড়ি থেকে লাইনের কথা বলে ২০ হাজার করে টাকা নিয়ে থাকেন বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করে। বিগত সরকারের শাসন আমলে এই জসিম উদ্দিনকে চোরাকারবারিরা তাদের মালবাহী গাড়ি পুলিশকে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগে হরিপুর এলাকায় নিয়ে তিনদিন আটক করে নির্যাতনের পরে ছাত্রলীগের লাইনম্যানরা জসিমকে চেকের বিনিময়ে সে সময় উদ্ধার করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। ছাত্রলীগের হয়ে জসিমের হাত ধরেই চলছে চোরাচালানের লাইনম্যানের কাজ।
সুএঃ দৈনিক অভিযোগ বার্তা