জামালপুর জেলা পর্যায়ে “সফল জননী” ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা দেওয়ানগঞ্জ’র মোছাঃ অবিরন নেছা।
মোঃ খোরশেদ আলম,স্টাফ রিপোর্টারঃ
০৯.১৩.২০২২ ইং তারিখে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস-২০২২ উপলক্ষে আয়োজিত জয়িতাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উনার হাতে “সফল জননী” সম্মাননা স্মারক এবং সনদ তুলে দিচ্ছেন জামালপুর জেলার সম্মানিত জেলা প্রশাসক শ্রাবস্তী রায়।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ডাংধরা ইউনিয়নের হারুয়াবাড়ী গ্রামে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা সংগ্রামী এক মায়ের নাম মোছাঃ অবিরন নেছা।তার জন্ম ১৯৬০ সালে। স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য তার হয়ে ওঠেনি। অল্প বয়সেই বিয়ে হয় একই ইউনিয়নে সোনাকুড়া গ্রামের মোঃ আলমাস হোসেনের সাথে, যিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি ছোট ব্যবসা করতেন।
দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে ছয়(০৬) সন্তানকে নিয়ে চলে তাদের অভাবের সংসার। অল্প বয়সেই বড় মেয়েকে বিয়ে দেন এবং বড় ছেলেকে সংসারের হাল ধরার কারণে বেশিদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করাতে পারেননি।
একসময় তিনি ভাবলেন এভাবে চলতে থাকলে ছেলেমেয়েদের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারবেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কষ্ট করে হলেও ছোট চার(০৪) ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। তিনি বাড়িতে ফলের গাছ ও সবজি চাষের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল-ভেড়া লালন পালন করে স্বামীর অভাবের সংসারে হাল ধরেন। নিজে পড়াশোনা না করতে পারলেও সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী। তিনি স্বপ্ন দেখতেন ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে একদিন বড় অফিসার হবে।
একটা সময় গিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ যোগান দেয়া তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠলেও তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। সামান্য যেটুকু কৃষি জমি ছিল তার কিছু অংশ বিক্রি এবং কিছু অংশ বন্ধ রাখার পাশাপাশি শিক্ষা ঋণ নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে যান। এ নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়-স্বজনসহ অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করলেও তিনি তার লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র পিছুপা হননি। তিনি ধৈর্য ধারণ করতেন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন যাতে করে শত কষ্টের মাঝেও তিনি তার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন। আজ তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে চার(০৪)জন স্নাতক-স্নাতকোত্তর উচ্চতর ডিগ্রী শেষ করে বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত আছেন।
বড় মেয়ে মোছাঃ লুৎফা বেগম বেশিদূর পড়াশোনা না করতে পারলেও মায়ের সংগ্রামী জীবন দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও তার দুই মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বড় মেয়ে(নাতনী) নাসিরাবাদ কলেজে অনার্সে অধ্যয়নরত এবং ছোট মেয়ে(নাতনী) মাধ্যমিকে পড়াশোনা করছে। বড় ছেলে মোঃ মেহের জামান অল্প বয়সে সংসারে হাল ধরার কারণে বেশিদূর পর্যন্ত পড়ােলখা না করতে পারলেও মায়ের সঠিক নির্দেশনায় ব্যবসা করে তিনিও আজ সমাজে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।তিনি তার দুই মেয়েকে (নাতনী) পড়াশোনার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তার জীবনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে চান।
মেজো ছেলে ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তিসহ ১৯৯৯ সালে রাজিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে প্রথম শ্রেণীতে স্টারমার্ক সহ উপজেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হন।২০০১ সালে সরকারি আশিক মাহমুদ কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। জাপান থেকে পিএইচডি ডিগ্রী শেষ করে বর্তমানে তিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগে সহোযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তার স্ত্রী(ছেলের বউ) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে জাপান থেকে সদ্য পিএইচডি ডিগ্রী সম্পন্ন করেন।
সেজো ছেলে মোঃ রেজাউল করিম প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তিসহ ২০০০সালে রাজিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে প্রথম শ্রেণীতে স্টারমার্ক সহ উপজেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ২০০২ সালে রাজিবপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে এইচএসসি শেষ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ৩১তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করে তিনি বর্তমানে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। তার স্ত্রী (ছেলের বউ) আনন্দমোহন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
ছোট ছেলে ডাঃ এস.এম. আরিফুল ইসলাম প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি সহ ২০০৫ সালে রাজিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে উপজেলার মধ্যে সর্বপ্রথম এ-প্লাস(জিপিএ ৫.০০) পেয়ে উত্তীর্ণ হন এবং ২০০৭ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসিতে এ-প্লাস(জিপিএ ৫.০০) পান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী শেষ করে ৪০তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করে তিনি বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দেওয়ানগঞ্জে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তার স্ত্রী(ছেলের বউ) শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে বর্তমানে জনতা ব্যাংক, দেওয়ানগঞ্জ ব্রাঞ্চে অফিসার পদে কর্মরত আছেন।
ছোট মেয়ে নুরুন্নাহার নুরী প্রাথমিকে বৃত্তি সহ ২০১০ সালে কাউনিয়ারচর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৪.৮১ এবং ২০১২ সালে রাজিপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ- ৪.৯০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে সদ্য অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তার স্বামী(মেয়ের জামাই) মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন এবং বর্তমানে তিনি পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য জাপানে আছে।
অভিযোগ বার্তা এর পক্ষ থেকে এই সংগ্রামী রত্নাগর্ভা মায়ের জন্য অনেক অনেক শুভ-কামনা।