মো. সাইফুল ইসলাম ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি ;
‘সরকার ঘর দিলে, মরার আগে একটু শান্তিতে থাকতাম’
রহিমা খাতুন। বয়স ষাটের ওপরে। চোখে মুখে সেই ছাঁপ স্পষ্ট। এই বয়সে তার নাতিপুতি নিয়ে আরাম আয়েসে থাকার কথা। কিন্তু রহিমা খাতুনের সেই সৌভাগ্য হয়নি। কারণ এই জগত-সংসারে তার আপন বলতে কেউ নেই। নেই স্বামী-সন্তানও।
হাতে গোনা কয়েকজন স্বজন থাকলেও তারাও না থাকার মতোই। শুধু তাই নয়, রহিমা খাতুনের কোনো সম্পদ নাই। নাই মাথা গোঁজার মতো কোনো ঘরও। তাই জীবন সায়ান্নে এসে এই নারী এখনো অন্যের বাসায় কাজ করেন। তার বিনিময়ে দুবেলা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাসাতেই কষ্টে কোনো রকম থাকেন।
রহিমা খাতুন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ৪ নং বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ দুয়ারী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা ফড়িং মোহাম্মদ ও মায়ের নাম সফুলা। বাবার সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। সুখের আশায় বাবা তাকে ১০-১২ বছর বয়সে বিয়ে দেন একই ইউনিয়নের পুহাতু মোহাম্মদের সঙ্গে। ভালোই চলছিল রহিমা পুহাতুর সংসার। দীর্ঘদিন ঘর সংসার করার পরে রহিমার কোলজুড়ে আসে এক ছেলে। কিন্তু সে সন্তান বেশি দিন বাঁচেনি। হুট করেই বাচ্চাটা মারা যায় তার। এরপর প্রায় ২০ বছর পুহাতু মোহাম্মদের সঙ্গে ঘর সংসার করেন রহিমা। কিন্তু আর সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। এরপর একে একে চলে গেছেন বাবা ফড়িং মোহাম্মদ ও পুহাতু মোহাম্মদ। তাদের হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে গেলেন রহিমা। শ্বশুর বাড়ির লোকজনও বাড়ি থেকে বের করে দেন তাকে। দিশেহারা হয়ে পড়লেন তিনি। উপায় না পেয়ে আবারও ঠাঁই নিলেন বাবার বাসায়। কিন্তু তার ভাই-বোনদেরই নুন আনতে পানতা ফুরোয়— অবস্থা। এরপর সবার ইচ্ছাতে বাপের বাড়ির এলাকার আবু হানিফের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয় তার। ৬ মাস সংসার করতে না করতেই আবু হানিফও মারা যান। সেই সংসারেও রহিমা খাতুনের কোনো সন্তান হয়নি। আবু হানিফেরও সহায় সম্বল বলতে তেমন কিছুই ছিল না। নিঃস্ব হয়ে পড়লেন রহিমা। জীবন চালাতে তিনি মানুষের বাসায় কাজ নেন তিনি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এভাবেই চলছে তার জীবন। কিন্তু এখন রহিমার বয়স হয়েছে। আগে মতো কাজও পারেন না। এজন্য অনেক কথা শুনতে হয়। অসুস্থ থাকলেও জোটে না ওষুধ।
রহিমা খাতুন বলেন, ‘শরীর চলে না তাও পেটের জ্বালায় মানুষের বাড়িতে কাজ করি। নিজের বাড়ি-ঘর, স্বামী সন্তান কিছুই নেই। থাকলে এইভাবে মানুষের বাড়িতে খেয়ে পড়ে থাকতে হতো না। সরকার অনেককে বাড়ি দিচ্ছে কিন্তু আমি মেম্বার চেয়ারম্যানকে বলেও শুধু থাকার জন্য একটি ঘর পাই না। সরকার ঘর দিলে, মরার আগে একটু শান্তিতে থাকতাম।’
এলাকার নাসিমা খাতুন নামে এক গৃহবধূ বলেন, কয়েক বছর ধরে রহিমা এইভাবে মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাচ্ছেন। তার থাকার একটি ঘরও নেই। এই গ্রামের মধ্যে তার মতো আর অসহায় কেউ নেই। খুব কষ্টে আছেন তিনি। সরকার থেকে তাকে একটি ঘর দিলে অন্তত তার থাকার জায়গা হতো।’
এলাকার মনিরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘রহিমার স্বামী-সন্তান না থাকায় তাকে দেখার মত কেউ নেই। সরকার থেকে তাকে যদি সাহায্য সহযোগিতা করা হয় তাহলে তার খুব উপকার হবে।’
একই গ্রামের তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘রহিমার সম্পদ বলতে তার কিছুই নেই। মানুষের বাসায় কাজ করে বা গ্রামের মানুষজন তাকে যা সাহায্য সহযোগিতা করে, তা দিয়ে খেয়ে পড়ে দিন কাটান তিনি।’
রহিমার ভাই আবুল হোসেন বলেন, ‘আমার বাবার সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই। শুধু একটু জায়গায় বাড়ি করে আছি। আমারও তেমন কোনো জায়গা জমি ও সম্পদ নেই। যা আছে তা দিয়ে নিজের সংসারই চলে না। আর আমার বোনকে কিভাবে চালাবো? তারপরও যতটুকু পারি ততটুকু দিয়ে সহযোগিতা করি তাকে। তার থাকার ঘরের জন্য কয়েকবার আবেদন করা হলেও তিনি এখনো কোনো ঘর পাননি। যদি পেত তাহলে অন্তত রাতে শান্তি মত একটু ঘুমাতে পারতো। বালিয়াডাঈী উপজেলার
৪ নং বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের রহিমা অনেক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের জন্য আবেদন করা হয়েছে। সেটি প্রক্রিয়াধীন আছে। আশা করা হচ্ছে, তিনি দ্রুত ঘর পেয়ে যাবেন।